আসাদ জামান
স্বদেশ, স্বজাতির মুক্তির সংগ্রামে একজন মানুষ কতটা ত্যাগ, কতটা কষ্ট স্বীকার করলে কালের সীমানা পেরিয়ে মহাকালের একজন হয়ে ওঠেন? হয়ে ওঠেন সে জাতির ভাগ্যনিয়ন্তা? অথবা স্থান করে নেন সে ভূ-খণ্ডের প্রতিটা মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়? কী শত্রু, কী মিত্র, কী একাল, কী সেকাল— সব লোকের, সব কালের, সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠতে নিজেকে কতটা বিলিয়ে দিতে হয়? অথবা কতটা বিলিয়ে দেওয়া সম্ভব, তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
৫৫ বছরের আয়ুকালে মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জীবনে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, দুঃখ-বেদনা, বঞ্ছনা-লাঞ্ছনা, অভাব-অনটন, শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা কম পোহাতে হয়নি টঙ্গীপাড়ার খোকাকে। কিন্তু তাকে সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে ব্রিটিশ ও পাকশাসকদের ‘কারাগার’। অসহ্য কারাযন্ত্রণা তাকে মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্ত নিয়ে গেছে অসংখ্যবার। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারির দিনটিতে ফরিদপুর কারাগারে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর বাঙালির পরম কাঙিক্ষত ‘চূড়ান্ত বিজয়ের’ দিন ১৬ ডিসেম্বরও তিনি ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। এভাবে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারেই কেটেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের— যা তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণিত হয়েছে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক জীবনে যে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন, এর মধ্যে স্কুলের ছাত্র অবস্থায় ব্রিটিশ আমলে সাত দিন। বাকি ৪ হাজার ৬৭৫ দিন তিনি কারাভোগ করেন পাকিস্তান সরকারের আমলে।
বছরের হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে ছিলেন প্রায় ১৪ বছর। ব্রিটিশ আমলে ১৯৩৮ সালে তিনি প্রথম কারাগারে যান। এরপর ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত তিনি পাঁচ দিন কারাগারে ছিলেন। একই বছর ১১ সেপ্টেম্বর আটক হয়ে মুক্তি পান ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি। এ দফায় তিনি ১৩২ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল আবারও কারাগারে গিয়ে ৮০ দিন কারাভোগ করে মুক্তি পান ২৮ জুন। ওই দফায় তিনি ২৭ দিন কারাভোগ করেন। একই বছরের ১৯৪৯ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৩ দিন এবং ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টানা ৭৮৭ দিন কারাগারে ছিলেন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পরও বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে যেতে হয়। সে সময়ে বঙ্গবন্ধু ২০৬ দিন কারা ভোগ করেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির পর বঙ্গবন্ধু ১১ অক্টোবর গ্রেফতার হন। এ সময়ে টানা ১ হাজার ১৫৩ দিন তাকে কারাগারে কাটাতে হয়। এরপর ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি আবারও গ্রেফতার হয়ে মুক্তি পান ওই বছরের ১৮ জুন। এ দফায় তিনি কারাভোগ করেন ১৫৮ দিন। এরপর ১৯৬৪ ও ১৯৬৫ সালে বিভিন্ন মেয়াদে তিনি ৬৬৫ দিন কারাগারে ছিলেন।
ছয় দফা দেওয়ার পর বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেখানে সমাবেশ করতে গেছেন, সেখানেই গ্রেফতার হয়েছেন। ওই সময়ে তিনি ৩২টি জনসভা করে বিভিন্ন মেয়াদে ৯০ দিন কারাভোগ করেন। এরপর ১৯৬৬ সালের ৮ মে আবারও গ্রেফতার হয়ে ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মুক্তি পান। এ সময় তিনি ১ হাজার ২১ দিন কারাগারে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই পাকিস্তান সরকার তাকে গ্রেফতার করে। এ দফায় তিনি কারাগারে ছিলেন ২৮৮ দিন।
এভাবে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, সন্তান-সন্ততী, প্রিতমা স্ত্রীকে পেছনে ফেলে জীবনের সুবর্ণ সময় কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন বাংলার রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ নিয়ে তার কোনো খেদ ছিল না। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন মানুষের জন্য, স্বদেশের জন্য, স্বজাতির জন্য, স্বাধীনতার জন্য, একটা মানচিত্রের জন্য, একখানা ভালো ছবির জন্য তাকে এই ত্যাগ স্বীকার করতেই হবে। সেটাই তিনি করেছিলেন।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।